মধ্যরাতের প্রেম-জেনারুল ইসলাম

এক্সপ্রেস সাহিত্য ডেস্ক রাত আড়াইটার দিকে আচমকা ঘুম ভেঙে যায়। মাঝেমধ্যেই এমনটা হয় তবে আজ একটু ব্যতিক্রম। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে অদ্ভুদ সব স্মৃতি চারপাশে ভীড় জমায়। দুশ্চিন্তা ঘুরঘুর করে মননে-মগজে। ফেলে আসা অতীতের অম্ল মধূর স্মৃতি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা কূলহীন সাগরে ভাঁসাতে থাকে। স্মৃতিগুলো বড্ড বেহায়া সময়ে অসময়ে হানা দেয়,বুঝে না রাত-বেরাত।
জানালা দিয়ে বাহিরে দৃষ্টি দিলে চেনা শহরটাও অচেনা লাগে। নেই কোলাহল, গাড়ির বিরক্তিকর হাইড্রোলিক হর্ণ। হঠাৎ দ্রুত গতিতে দু একটা গাড়ি আসে যায়। কদাচিৎ আসে লাল সিগনালের এম্বুলেন্স । অবশ্য ছিন্নমূল গৃহহীন জনকয়েক মানুষ ফুটপাতে দেখা যায় আপাদমস্তক কাঁথামোড়া দিয়ে স্বর্গসুখে ঘুমিয়ে আছে তারপাশে দুচারটে কুকুর।
এমন নির্ঘুম ভাবনার রাতে মাঝেমধ্যেই কমলিকা চলে আসতো। আজ রাতেও এসেছিলো আর তখনই আচমকা কাচাঘুমটা ভেঙে যায়। কমলিকা আসলে আর ঘুমিয়ে থাকা যায় না জেগেও থাকতে পারি না। ঘুম সজাগের খেলায় বিভোর থাকি।
কমলিকাকে প্রথম দেখেছিলাম বছর দেড়েক আগে। ঈদের ছুটিতে তখন আমি গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। গোধূলিলগ্নে গ্রামের কুয়াশা ভেজা দুর্বাঘাস মাড়িয়ে আলপথ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করি। এলোমেলো চিকন মেঠোপথ ধরে হাঁটছিলো সে। প্রথম দেখার পলকেই আমি রিতিমতো থমকে যাই। গ্রামের মেঠোপথে এ কোন শহুরে মেয়ে!
আগাগোড়া আধুনিকতায় ঢাকা কোন মেয়ে আমার এলাকায় থাকতে পারে এ আমার বিশ্বাসে ছিলো না। তবে দেখে মনে হচ্ছে গ্রামের নয় এ শহুরে মেয়ে।
হয়তো ঈদের ছুটিতে গ্রামে বেড়াতে এসেছে।
সামনে যাবার সাহস পাই নি। আলপথের মোড় ঘুরিয়ে সেদিন কোনমতে চলে আসি।
কিন্তু সে পিছু ছাড়ে নি।
মাঝেমধ্যে এভাবেই আচমকা এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় মাঝরাতে!
কমলিকাদের বাড়ির সামনে ছোট একটা চায়ের স্টল আছে। সকাল-সন্ধ্যায় মুরুব্বিদের সংসদ বসে সেখানে। ছোট পর্দায় বাংলা ছায়াছবি চলে সেই সাথে বিশ্বরাজনীতির তর্কযুদ্ধ। এখানকার একেকজন মুরুব্বি মানে একেকজন রাজনীতিবিশ্লেষক। সচরাচর আমাদের বয়সী ছেলেরা সেখানে বসে না। বসলে গ্রামের মুরুব্বীরা বেয়াদব বলবে। তবুও আমি প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় সেখানটাতে বসতাম। মুরুব্বীদের কথা শোনার ছলে কমলিকাদের বাড়িতে চেয়ে থাকতম। তবে দুএক দিন দেখেছিলাম অস্পষ্ট আবছায়ায়।
ঈদের ছুটি কাটিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ছেড়ে চলে আসি মহাসড়কে। এটাকে রাজপথ বলে। যেখানটাতে রক্তের হোলিখেলা হয়,অবরোধ,হরতাল,স্লোগান,মিছিল-মিটিং আর গোলাবারুদের বিস্ফোরণে ব্যস্ত থাকে সবসময়। শহুরের দিনগুলো বড়ো নিষ্ঠুর,একঘেয়েমি আর হিংসুটে। সঙ্গ দেয় না। ব্যস্ততার অজুহাতে দূরে ঠেলে দেয়। ক্লান্তিকর দিনগুলোতে কমলিকা আসে না। আমিও মনে রাখতে পারি না তাকে।
সেদিন দেখার পর থেকে নীবর,নিঃস্তব্ধ রাতে কখনো বা মেঘলা রাতে কমলিকা চুপি চুপি আমার কাছে চলে আসতো। কমলিকা কখন আসতো বুঝতে পারতাম না। দরজার শব্দ হতো না,রুমের লাইট জ্বলতো না কিংবা সে হোঁছট খেয়ে পড়লেও তো কোথাও না কোথাও শব্দ হতো এমনটাও হতো না। আমার এ শোবার ঘরটি তার খুব চেনা। অন্ধকারেও নির্দ্বিধায় হাঁটতে পারে সোজা আমার বিছানা বরাবর। পরশু রাতেও এসেছিলো তবে আবার ঘুম পাড়িয়ে কখন চলে গেলো বুঝতে পারি নি। তাই আজ শোবার আগে ভেবেছিলাম আজ যখন আসবে যেতে দেবো না। হাতটা ধরে বসে থাকবো সকাল অবধি। চাঁদের আলোতে আর ক-তো দেখবো? এবার সূর্যের আলোয় তোমায় দেখতে চাই।
কমলিকা যতবার এসেছে ততবার আমি আর আমিতে ছিলাম না। নিজের চিরচেনা রূপকে হারিয়ে অচেনা আমি হয়েছি কতোবার। কমলিকার একটা অভ্যেস ছিলো সে এসেই ময়ূরের পাখনার মতো কী যেন একটা দিয়ে শরীরটা বুলিয়ে দিতো। এতে ঘুম-সজাগের মাঝামাঝি বিস্ময়কর অনুভূতি হতো।
তবে চলে যাবার পর বাকি রাতটুকু দুচোখের পাতা দুটো আর এক হতো না। মাঝরাতে ঘুম ভাঙা…..!
মাঝেমধ্যেই এমনটা হয় আজ একটু ব্যতিক্রম!
আজ বেডরুমে গিয়েছিলাম রাত সাড়ে এগারটার দিকে। আড়াইটার দিকে কমলিকার আগমন। দশ পনের মিনিট এখানটাতে ছিলো। তারপর উদাও।
রক্তরাঙা চোখ দুটো কচলাচ্ছি। বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা হটাৎ পটাং শব্দে বেঁজে উঠে। ইদানীং একটি ভূল বারবার করি ওয়াইফাই বন্ধ না করেই ঘুমিয়ে যাই। সময়ে অসময়ে পটাং পটাং শব্দ করে।
অনিচ্ছাসত্ত্বে ফোনটা হাতে নিই।
মেসেঞ্জারটা ভেসে উঠে। রোজ কুইন আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।
– এতোরাতে সজাগ কেনো?
– কে আপনি? আমি সজাগ থাকলে আপনার কি? তাছাড়া আমি ঘুমে ছিলাম আপনি নক দিয়েই সজাগ করলেন।
-আপনি তো অনলাইনে এক্টিভ ছিলেন। ঘুমে কিভাবে?
– সে আপনি বুঝবেন না। আচ্ছা আপনার নাম কি? রোজ কুইন কারো নাম হয়?
– আমি কমলিকা।
-কমলিকা!
কমলিকা নামটা শোনার পর কিছুটা হতভম্ব হয়ে যাই। কোথায় যেনো শুনেছি নামটা?
কমলিকা কি আমার মধ্যরাতের গল্পটা? ঠিক মনেও পড়ছে না। তবে কমলিকা নামটা খুব ভালো লেগেছে।
সে রাতে ওয়াইফাই অফ করে ঘুমিয়ে পড়ি। রাতের খবর আর জানি নে। রাতের কথাগুলো ভোর অবধিই থাকে। সকাল হতেই শেষ।
জেনারুল ইসলাম
পূর্ব দরগা গেইট
আম্বরখানা,সিলেট।